বেদ(কোন মানুষ বেদের রচয়িতা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরই এর রচয়িতা।)
‘দর্শন করেন বলেই তাঁদের ঋষি বলা হয়। তপস্যার গভীরে ঋষিদের কাছে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মবাণী বেদ স্বয়ং আগমন করে এজন্যও তাঁদের ঋষি বলা হয়। ঋষিদের কাছে বেদবাণী ছবির মতো ভেসে ওঠে ধ্যানের গভীরে। এ বেদবাণী দর্শনের জন্যই তাঁদের মন্ত্রদ্রষ্টা বলা হয়; মন্ত্রস্রষ্টা নয়। পরাশর সংহিতায় (১/২০) বলা হয়েছে ‘ন কশ্চিৎ বেদকর্তাস্তি’। কোন মানুষ বেদের রচয়িতা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরই এর রচয়িতা। দ্রষ্টা ঋষিরা অমৃতময় বেদকে শিষ্য পরম্পরায় শ্রুতির মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন। এভাবেই শ্রুতি পরম্পরায় বেদ ধরা ছিল বহুদিন। একারণেই এর অন্য নাম শ্রুতি।’
বেদ শব্দটি বিদ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার উৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান। এ জ্ঞান কোন সাধারণ জ্ঞান নয়; এক অতীন্দ্রিয় অপৌরুষের জ্ঞান। ঝর্ণা ধারার মত স্নিগ্ধ এ জ্ঞান জীব কল্যাণে নেমে এসেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। বেদে ভগবান ঘোষণা করেছেন- অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ: প্রথম অধ্যায়, দশম অনুবাক)
আমিই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক। তিনি পৃথিবী কীভাবে চলবে তার একটি নির্দেশিকা দিয়েছেন, সে নির্দেশিকাই বেদ। তাইতো ঋষি মনু বলেছেন, ‘বেদঃ অখিলধর্মমূলম্।বেদ অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধর্মের মূল। প্রায় একই কথা ধর্ম সূত্রকার ঋষি গৌতমও বলেছেন- ‘বেদঃ ধর্মমূলম্।’ বেদের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপে অবিহিত করা হয়েছে। “অস্য মহতো ভূতস্য নি:শ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ”। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২.৪.১০)
সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ং প্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নি:শ্বাসস্বরূপ। যেমন বায়ুপ্রবাহ বিহীন আমরা এক দণ্ডও বেঁচে থাকতে পারি না। তেমনি ঈশ্বরের নি:শ্বাসরূপ বেদের জ্ঞানপ্রবাহহীন আমরা চলতে পারবো না, আমাদের মানবসভ্যতার জ্ঞানপ্রবাহ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাইতো কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে বেদজ্ঞান প্রবাহের প্রকাশ ঘটান। “যুগান্তে অন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ। লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা স্বয়ম্ভূবা।” (মহাভারত: শান্তিপর্ব, ২১০.১৯)
যুগান্তে প্রলয়কালে বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞান পুনরায় লাভ করেন।
অর্থাৎ কল্পে কল্পে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন। ঋষিদের বলা হয় ‘সাক্ষাৎকৃতধর্মাণ। যাঁরা অখিল ধর্মের মূল বেদকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছেন, তাই তাঁরা ঋষি। নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন- স্বয়ম্ভূ অভ্যানর্ষত্তদূষীর্ণামৃষিত্মম্। (নিরুক্ত : ২.১)
দর্শন করেন বলেই তাঁদের ঋষি বলা হয়। তপস্যার গভীরে ঋষিদের কাছে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মবাণী বেদ স্বয়ং আগমন করে এজন্যই তাঁদের ঋষি বলা হয়। ঋষিদের কাছে বেদবাণী ছবির মত ভেসে ওঠে ধ্যানের গভীরে। এ বেদবাণী দর্শনের জন্যই তাঁদের মন্ত্রদ্রষ্টা বলা হয়; মন্ত্রস্রষ্টা নয়। পরাশর সংহিতায় (১/২০) বলা হয়েছে-‘ন কশ্চিৎ বেদকর্তাস্তি’। কোন মানুষ বেদের রচয়িতা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরই এর রচয়িতা। দ্রষ্টা ঋষিরা অমৃতময় বেদকে শিষ্য পরম্পরায় শ্রুতির মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন। এভাবেই শ্রুতি পরম্পরায় বেদ ধরা ছিল বহুদিন। একারণেই এর অন্য নাম শ্রুতি।
শতশত ঋষিদের নিকট থেকে লক্ষাধিক মন্ত্র নিয়ে একসাথে সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশ করেন শ্রীকৃষ্ণ নামক এক ঋষি। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় ‘বেদব্যাস’। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ঋষি পরাশর এবং জেলে কন্যা সত্যবতীর পুত্র। যিনি পৃথিবীতে ‘ব্যাসদেব’ নামেই প্রাতঃস্মরণীয়। ব্যাসদেব চিন্তা করলেন অনন্ত এ বেদজ্ঞান একত্রে গ্রহণ করা মানবের পক্ষে দুঃসাধ্য। তাই তিনি বেদবিদ্যাকে চারভাগে বিভক্ত করে তাঁর প্রধান চার শিষ্যকে দান করলেন। পৈলকে দিলেন ঋগ্বেদ। জৈমিনিকে দিলেন সামবেদ। বৈশম্পায়নকে দিলেন যুজর্বেদ এবং পরিশেষে সুমন্তকে দিলে অথর্ববেদ। ব্যাসদেবের প্রধান এ চার শিষ্য জগতে বেদবিদ্যার প্রচার করেন তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে। এভাবেই গুরুশিষ্য পরম্পরায় বেদজ্ঞান শত শত শাখায় বিকশিত হয়ে ওঠে এবং জগতে বেদবিদ্যার অমৃতধারাকে দিকে দিকে প্রবাহিত করে তোলে।
বেদ কোন একটি গ্রন্থ নয়, অসংখ্য গ্রন্থের সমষ্টি। এ গ্রন্থের সমষ্টি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত- মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ। বেদের প্রাচীন কল্পসূত্রকার আপস্তম্ব তাঁর যজ্ঞপরিভাষাসূত্রে (১/৩৪) বলেছেন-‘মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্’ অর্থাৎ মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণকে একত্রে বেদ বলে। এ মতকেই সমর্থন করে চতুর্দশ শতাব্দীর বেদভাষ্যকার সায়নাচার্য তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্যোপক্রমণিকায় বলেছেন- ‘মন্ত্রব্রাহ্মণাত্মকঃ শব্দরাশির্বেদঃ।’ মন্ত্র অংশকে সংহিতা বলা হয়। সংহিতা অর্থ সংকলন। অর্থাৎ এখানে বিভিন্ন ঋষিদৃষ্ট মন্ত্রগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে সাজানো থাকে বলে তাকে সংহিতা বলা হয়। ব্রাহ্মণ অংশ দুটি ভাগে বিভক্ত- আরণ্যক এবং উপনিষদ। সুতরাং বেদ বলতে আমরা বুঝি চার প্রকার শাস্ত্রগ্রন্থকে যথা (১) সংহিতা (২) ব্রাহ্মণ (৩) আরণ্যক ও (৪) উপনিষদ। এদের মধ্যে সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় ক্রিয়া বা কর্মকাণ্ড। যেখানে যাগযজ্ঞ বিভিন্ন প্রকার বিধি ব্যবস্থার কথাই প্রধানত আছে। অবশিষ্ট আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা হয় জ্ঞানকাণ্ড; যেখানে বিভিন্ন প্রকার উপাসনা বিধি এবং অধ্যাত্মবিদ্যাই মূখ্য আলোচনার বস্তু। যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বেদান্তদর্শন।
শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস সম্পাদিত বেদবিদ্যা
ঋগ্বেদ
ঋষি পৈল
সংহিতা: ১০২৮টি সূক্ত এবং ১০,৬০০ মন্ত্র বা ঋক্
ব্রাহ্মণ: ১) ঐতরেয় ব্রাহ্মণ
২) কৌষীতকি বা শাঙ্খায়ণ ব্রাহ্মণ
আরণ্যক: ১) ঐতরেয় আরণ্যক
২) কৌষীতকি আরণ্যক
উপনিষদ: ১) ঐতরেয় উপনিষদ
২) কৌষীতকি উপনিষদ
সামবেদ
ঋষি জৈমিনি
সংহিতা: ১৮১০ টি মন্ত্র বা সাম।এর মধ্যে ৭৫টি ছাড়াসবই ঋগ্বেদের মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি।
ব্রাহ্মণ: ১) পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ
২) ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ
৩) ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ
৪) জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ
৫) সামবিধান ব্রাহ্মণ
৬) দেবতাধ্যায় ব্রাহ্মণ
৭) আর্ষের ব্রাহ্মণ
৮) বংশ ব্রাহ্মণ
আরণ্যক: ১) ছান্দোগ্য আরণ্যক
উপনিষদ: ১) ছান্দোগ্য উপনিষদ
২) কেন উপনিষদ
যজুর্বেদ
ঋষি বৈশম্পায়ন
কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা
সংহিতা: ২১৮৪ টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র।
ব্রাহ্মণ: ১) তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ
আরণ্যক: ১) তৈত্তিরীয় আরণ্যক
উপনিষদ: ১) কঠ উপনিষদ
২) শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ
৩) মহানারায়ণ উপনিষদ
৪) মৈত্রায়ণ উপনিষদ
৫) তৈত্তিরীয় উপনিষদ
শুক্লযজুর্বেদ বা বাজসনেয় সংহিতা
ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য
সংহিতা : ১৯১৫টি কণ্ডিকা বা মন্ত্র
ব্রাহ্মণ: শতপথ বাহ্মণ
আরণ্যক: বৃহদারণ্যক
উপনিষদ: ১) বৃহদারণ্যক উপনিষদ
২) ঈশ উপনিষদ
অথর্ববেদ
ঋষি সুমন্ত
সংহিতা: ৫৯৭৭টি মন্ত্র।
ব্রাহ্মণ: গোপথ ব্রাহ্মণ
আরণ্যক: নেই
উপনিষদ: ১) প্রশ্ন উপনিষদ
২) মুণ্ডক উপনিষদ
৩) মাণ্ডুক্য উপনিষদ
বেদাঙ্গ
সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ ছাড়াও প্রত্যেক বেদের সাথে যুক্ত আরও চার প্রকারের সূত্র আছে তাদের বলা হয় কল্পসূত্র। সায়নাচার্য তাঁর ঋগ্বেদ – ভাষ্যোপক্রমণিকায় বলেছেন- ‘কল্প্যতে সমর্থ্যতে যাগ প্রয়োগোহত্রইতি’। অর্থাৎ যার দ্বারা যাগযজ্ঞাদি কল্পিত বা সমর্থিত হয় তাকে কল্প বলে। বৃত্তিকার বিষ্ণুমিত্রের মতে ‘কল্পো বেদ বিহিতানাং কর্মনামানুপূর্ব্যণে কল্পনা শাস্ত্রম্।’ অর্থাৎ কল্প হলো বেদবিহিত কর্মের নিয়মানুসারী ব্যবস্থা বিধায়ক শাস্ত্র। এ কল্পসূত্র প্রধানত দুই প্রকার- শ্রৌতসূত্র এবং গৃহ্যসূত্র। এ দুটি ভাগের মধ্যে আবার দুটি করে ভাগ নিহিত আছে। শ্রৌতসূত্রের সাথে আছে যজ্ঞের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শুল্বসূত্র এবং গৃহ্যসূত্রের সাথে যুক্ত আছে ধর্মসূত্র। এভাবে আমরা চার প্রকার কল্পসূত্র পাই- (১) গৃহ্যসূত্র, (২) ধর্মসূত্র, (৩) শ্রৌতসূত্র এবং (৪) শুল্বসূত্র।
প্রত্যেক বেদেরও পৃথক পৃথক কল্পসূত্র আছে। প্রাচীনকালে বেদের যতগুলো শাখা ছিল, ঠিক ততগুলিই কল্পসূত্র ছিল বলে বিশ্বাস। প্রাচীন উৎস থেকে জানা যায়, পূর্বে কল্পসূত্র ছিল ১১৩০টি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে এতগুলো কল্পসূত্র পাওয়া যায় না। বর্তমানে পাওয়া যায় প্রায় ৫০টি কল্পসূত্র। নিচে এর তালিকা দেয়া হলো।
ঋগ্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) আশ্বলায়ন (২) শাংখায়ন (৩) পরশুরাম।
গৃহ্যসূত্র : (১) আশ্বলায়ন (২) শাংখায়ন।
ধর্মসূত্র : (১) বশিষ্ঠ
সামবেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) লাট্যায়ন বা আর্ষেয়কল্প (২) দ্রাহ্যায়ন (৩) জৈমিনীয়।
গৃহ্যসূত্র : (১) গোভিল (২) দ্রাহ্যায়ন (৩) জৈমিনীয় (৪) খাদির।
ধর্মসূত্র : (১) গৌতম।
কৃষ্ণযজুর্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) মানব (৪) সত্যাষাঢ় বা হিরণ্যকেশী (৫) বৈখানস।
গৃহ্যসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) মানব (৪) হিরণ্যকেশী (৫) ভারদ্বাজ (৬) বারাহ (৭) কাঠক (৮) লৌগাক্ষি (৯) বৈখানস (১০) বাধুল।
ধর্মসূত্র : (১) মানব (২) বৌধায়ন (৩) আপস্তম্ব (৪) হিরণ্যকেশী (৫) বৈখানস।
শুল্বসূত্র : (১) বৌধায়ন (২) আপস্তম্ব (৩) হিরণ্যকেশী (৪) কাঠক (৫) মানব (৬) বারাহ।
শুক্লযজুর্বেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) কাত্যায়ন।
গৃহ্যসূত্র : (১) পারস্কর বা বাজসনেয়।
ধর্মসূত্র : (১) শঙ্খ (২) লিখিত।
শুল্বসূত্র : (১) কাত্যায়ন।
অথর্ববেদ
শ্রৌতসূত্র : (১) বৈতান।
গৃহ্যসূত্র : (১) কৌশিক।
ধর্মসূত্র : (১) পঠিনসী।
ঋগ্বেদ, সামবেদ, শুক্লযজুর্বেদ, কৃষ্ণযজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ এ পাঁচপ্রকারের প্রত্যেকের অন্তর্ভুক্ত সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ নিয়ে সমগ্র বেদবিদ্যা। এর মধ্যে শুধু অথর্ববেদের কোন আরণ্যক নেই। সমগ্র বেদবিদ্যাকে যদি জ্ঞানরাজ্যের একটি তালা রূপে কল্পনা করা হয় তবে সেই তালা খুলতে ছয়টি চাবির প্রয়োজন। অন্য সাধারণ তালা থেকে এর পার্থক্য, এ তালা খুলতে একই সাথে ছয়টি চাবির প্রয়োজন। কোন একটি চাবি বাদ পড়লে তালাকে খোলা যাবে না। এ ছয়টি চাবিই হল বেদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ষড়বেদাঙ্গ। শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দ, জ্যোতিষ। অথর্ববেদীয় মুণ্ডক উপনিষদে আমরা বেদাঙ্গ সহ বেদবিদ্যার তালিকা পাই- “তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি।” (মুণ্ডক উপনিষদ: প্রথম মুণ্ডক, প্রথম অধ্যায়, মন্ত্র-৫)
–অপরা বিদ্যা ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ এবং জ্যোতিষ এ দশটি।
1Vedaবেদে ধ্বনিতত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেবার কারণে ধ্বনিতত্ত্বকে আলোচনার মাধ্যমেই প্রথম বেদাঙ্গ শিক্ষা শুরু হয়। যে শাস্ত্রে বর্ণ, স্বর, মাত্রা ইত্যাদির যথাযথ উচ্চারণ ও প্রয়োজনবিধি লিপিবদ্ধ আছে তাকে শিক্ষা বলে। প্রত্যেক বেদের সাথে শিক্ষা যুক্ত আছে। যথা- ঋগ্বেদ : পাণিনীয় শিক্ষা সামবেদ : নারদীয় শিক্ষা যজুর্বেদ : যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা অথর্ববেদ : মাণ্ডূকী শিক্ষা ।
২. কল্প : বেদাঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হলেও কল্পসূত্র গুলি মূল বেদের সাথে এমনভাবে যুক্ত যে চার প্রকার (ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ) বেদের সাথে সে অচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। তাই পূর্বে চার প্রকার বেদের সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদের তালিকার সাথে সাথে চার প্রকার কল্পসূত্রেরও তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং কল্প সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা সেখানেই করা হয়েছে। তবুও আমরা চার প্রকার সূত্রের নাম দিয়ে দিচ্ছি।
শ্রৌতসূত্র : যাগযজ্ঞ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিধি ব্যবস্থা সংক্রান্ত সূত্র।
গূহ্যসূত্র : এ সূত্রগুলোকে আমরা এক কথায় বলতে পারি পারিবারিক আইন। অর্থাৎ একজন মানুষের পরিবারে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করণীয় কর্তব্য।
ধর্মসূত্র : ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজনিষ্ঠ নাগরিক জীবনের কর্তব্য। এতে ধর্ম সম্বন্ধীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার বিধিনিষেধাদি লিপিবদ্ধ আছে।
শুল্বসূত্র : শুধুমাত্র যজুর্বেদেরই শুল্বসূত্র পাওয়া যায়। যজুর্বেদ যেহেতু যজ্ঞসম্বন্ধীয়, তাই যজ্ঞবেদির নির্মাণে শূল্বসূত্রের একান্ত প্রয়োজন। শুল্ব অর্থ পরিমাপ। বিধি প্রকার যজ্ঞবেদি নির্মাণে এ পরিমাপ একান্ত প্রয়োজনীয়। শুল্বসূত্রকে পৃথিবীর প্রাচীনতম জ্যামিতির নিদর্শন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভাবতে অবাক লাগে ইউক্লিড, থ্যালিস, পিথাগোরাসের বহু পূর্বে আমাদের দেশের ঋষিরা কত অসাধারণভাবে জ্যামিতি বিজ্ঞানের চর্চা করেছেন।
৩. নিরুক্ত: ‘নির্ঘণ্টু’ নামক পঞ্চ অধ্যায়ে বিভক্ত কোষ গ্রন্থই নিরুক্তের প্রাচীনতম উৎস। এ কোষ গ্রন্থটি অজানা কোন এক ঋষি প্রণীত। এ নির্ঘণ্টু নামক ১৭৭১টি শব্দতালিকার উপরই যাস্ক মুনি ব্যাখ্যামূলক একটি কোষগ্রন্থ রচনা করেন; তাই নিরুক্ত। নিঃশেষরূপে পদসমূহ এতে উক্ত হয়েছে বলে একে নিরুক্ত বলে। ‘নির্ঘণ্টু’ এবং যাস্কমুনি রচিত এর ব্যাখ্যা নিরুক্তই পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন অভিধান কোষ। নিরুক্ত তিনটি ভাগে বিভক্ত- (১) নৈর্ঘণ্টুকাণ্ড (২) নৈগম কাণ্ড ও (৩) দৈবত কাণ্ড।
৪. ব্যাকরণ: কোন একটি ভাষার ভিত্তিসৌধ রচিত হয় সেইভাষার ব্যাকরণের উপর। বেদের ন্যায় প্রাচীনতম ভাষার ক্ষেত্রে এ কথাটি সর্বাংশে সত্য। একারণে পাণিনীয় শিক্ষায় ব্যাকরণকে বেদের মুখ বলা হয়েছে। বি-আ-কৃ+অনট্= ব্যাকরণ। তাই ব্যাকরণ শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ- ব্যাকৃত করা, প্রকাশিত করা, ছড়িয়ে দেয়া। বেদবিদ্যাকে প্রকাশিত করার জন্য ব্যাকরণবিহীন অসম্ভব। এ কারণে পতঞ্জলির মহাভাষ্যে ব্যাকরণের প্রয়োজন বোঝানোর জন্য কাত্যায়ণ বররুচির একটি বার্ত্তিক উল্লেখ করা হয়েছে-‘রক্ষোহাগমলঘ¡সন্দেহাঃ প্রয়োজনম্।’ অর্থাৎ রক্ষা, ঊহ, আগম, লঘু এবং অসন্দেহ- এ পাঁচটি বিষয়ের জন্য ব্যাকরণের প্রয়োজন।
রক্ষা : বেদের রক্ষার জন্য ব্যাকরণের প্রয়োজন। প্রকৃতি, প্রত্যয়, সন্ধি, সমাস, বর্ণের লোপ, বর্ণের আগম, বর্ণবিকার সম্বন্ধে যিনি সঠিকভাবে জানেন তিনিই বিশুদ্ধভাবে বেদের জ্ঞান লাভ করতে পারবেন এবং বিশুদ্ধ বেদবিদ্যার ধারাকে রক্ষা করতে পারবেন।
ঊহ: সঠিক বিচার করে পরিবর্তন। কারণ বেদে সমস্ত লিঙ্গ এবং সমস্ত বিভক্তিতে মন্ত্রগুলি পঠিত হয়নি। যিনি যজ্ঞ করবেন তাঁর প্রধান কর্তব্য সঠিক ব্যাকরণ জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি যজ্ঞের প্রয়োজন অনুযায়ী মন্ত্রগুলির যথাযথ পরিবর্তন সাধন করে যজ্ঞকর্ম সমাধা করবেন।
আগম : কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হয়ে ষড়বেদাঙ্গসহ বেদ অধ্যয়ন করা এবং অবগত হওয়া জ্ঞানী ব্যক্তির কর্তব্য। অর্থাৎ নিষ্কামভাবে বেদবিদ্যাকে ভালবেসে সঠিক বেদবিদ্যার চর্চার জন্যও ব্যাকরণের প্রয়োজন।
লঘু: লঘু অর্থ সংক্ষেপ। অর্থাৎ ভাষাকে সহজ এবং সংক্ষিপ করার জন্যও ব্যাকরণ অধ্যয়ন করা উচিত। বেদজ্ঞকে সঠিক বেদজ্ঞানের জন্য অসংখ্য শব্দ জানতে হবে। কারণ শব্দজ্ঞানবিহীন ব্যক্তি বেদরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাই ব্যাকরণই একমাত্র সহজতর এবং সংক্ষেপতম উপায় যথার্থ শব্দ জ্ঞান লাভের।
অসন্দেহ: বেদমন্ত্রের সন্দেহ নিবারণের জন্যও ব্যাকরণ অধ্যয়ন করা উচিত।
এ পাঁচটি প্রধান প্রয়োজনের অতিরিক্ত মহর্ষি পতঞ্জলি (খ্রি. পূ. দ্বিতীয় শতক) শব্দানুশাসনের অর্থাৎ ব্যাকরণের আরও ১৩টি প্রয়োজনের কথা বলেছেন-
(১) তেহসুরাঃ (২) দুষ্টঃ শব্দঃ (৩) যদধীতম্ (৪) যন্তু প্রযুঙ্ক্তে (৫) অবিদ্বাংসঃ (৬) বিভক্তিং কুর্বন্তি, (৭) যো বা ইমাম্ (৮) চত্বারি (৯) উত ত্বঃ (১০) সক্তুমিব (১১) সারস্বতীম্ (১২) দশম্যাং পুত্রস্য (১৩) সুদেবো অসি বরুণ
৫. ছন্দ: বেদ মন্ত্রের জন্য ছন্দের জ্ঞান অপরিহার্য। কারণ চারবেদের অধিকাংশ মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। বৈদিক ছন্দ সাতটি। গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পঙ্ক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতী। বৈদিক ছন্দকে অক্ষরছন্দ বলা হয়। কারণ মন্ত্রের অক্ষরের সংখ্যা গুণে গুণে নির্ণয় করতে হয়। অক্ষর বলতে কোনবর্ণ নয়, শব্দ উচ্চারণের স্বল্পতম প্রয়াসকে বোঝায়। যাকে আমরা ইংরেজিতে Syllable বলি। গায়ত্রী ছন্দে অক্ষরের সংখ্যা ২৪টি, উষ্ণিক ছন্দে ২৮টি, অনুষ্টুপ ছন্দে ৩২টি, বৃহতী ছন্দে ৩৬টি, পঙ্ক্তি ছন্দে ৪০টি, ত্রিষ্টুপ ছন্দে ৪৪টি এবং সর্বশেষে জগতী ছন্দে অক্ষরের সংখ্যা ৪৮টি। লক্ষ্য করলে দেখা যায় অসাধারণ গাণিতিক বিন্যাসে বৈদিক ছন্দের উদ্ভব। অর্থাৎ গায়ত্রী থেকে জগতী পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছন্দে পর্যায়ক্রমে চারটি করে অক্ষরের বৃদ্ধি ঘটেছে। এ কারণেই ঋষি কাত্যায়ন বলেছেন (কাত্যায়ন ১/১), “যিনি ঋষি ছন্দ দেবতা ও মন্ত্রের বিনিয়োগ না জেনে মন্ত্রের দ্বারা যাগ করেন বা অধ্যয়ন-অধ্যাপন করেন, তিনি কাঠের গুঁড়ির মত কেবল ভারবাহী হন অথবা গর্তে পতিত হয়ে পাপে আচ্ছন্ন হন।” একারণেই ছন্দ জানার জন্য ছন্দগ্রন্থের প্রয়োজন। ছন্দ সম্পর্কে যাস্কের নিরুক্তে বলা হয়েছে, ‘ছন্দাংসি ছাদনাৎ’ (৭/১২) অর্থাৎ আচ্ছাদন করে বলে তাকে ছন্দ বলে। কি থেকে আচ্ছাদন? পাপ থেকে আচ্ছাদন। অর্থাৎ যা মৃত্যু থেকে রক্ষা করে অমৃতে নিয়ে যায় তাই ছন্দ। পূর্বে হয়ত একাধিক ছন্দোগ্রন্থ ছিল কিন্তু বর্তমানে একমাত্র ঋষি পিঙ্গল রচিত ‘পিঙ্গলছন্দসূত্র’ই একমাত্র বিদ্যমান। পিঙ্গলছন্দসূত্রের উপর হলায়ুধ ভট্টের বৃত্তি অনন্য।
৬. জ্যোতিষ: ষড়বেদাঙ্গের সর্বশেষ জ্যোতিষ। এ জ্যোতিষ বর্তমানে প্রচলিত হস্তরেখা বিদ্যা নয়। এ হলো নক্ষত্রবিদ্যা। যাকে আমরা ইংরেজিতে বলতে পারি ‘ঠবফরপ অংঃৎড়হড়সু’। সে যুগে বর্তমান কালের মত ঘরে ঘরে ক্যালেন্ডার ছিল না, কিন্তু সে সময়েও তিথি-নক্ষত্রের হিসাব রাখতে হতো। শ্রৌতশাস্ত্রগুলোর মধ্যে দেখা যায় অধিকাংশ যজ্ঞেরই তিথি নক্ষত্র এবং ঋতু উল্লেখ করে দেয়া আছে। অর্থাৎ কখন এ যজ্ঞকর্মটি করতে হবে। যেমন শতপথ ব্রাহ্মণে যে ‘দশপূর্ণমাস’ নামক যজ্ঞের কথা বলা আছে তা অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত করতে হয়। অর্থাৎ কেউ যদি কখন অমাবস্যা এবং কখন পূর্ণিমা তা না জানেন তাহলে সে যজ্ঞ কর্ম সমাধা করতে পারবেন না। এ কারণেই তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে, ‘যজ্ঞকাল সিদ্ধির জন্য জ্যোতিষের প্রয়োজন’। বৈদিক জ্যোতিষের বিভিন্ন তত্ত্বের উল্লেখ পাই আমরা ঋগ্বেদের কিছু মন্ত্রে এবং শতপথব্রাহ্মণে। বৈদিক জ্যোতিষের দুটি গ্রন্থ পাওয়া যায়-একটি ঋগে¦দীয়, এতে আছে ৩৬টি শ্লোক এবং অন্যটি যজুর্বেদীয়, এতে আছে ৪৩টি শ্লোক। এ গ্রন্থ দুটিতে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নে চন্দ্রসূর্যের অবস্থান অমাবস্যা, পূর্ণিমা তিথি এবং নক্ষত্রম-ল ইত্যাদি বিবিধ বৈজ্ঞানিক বিষয়ের আলোচনা আছে।
বেদান্ত
ভারতীয় পরম্পরার বৈশিষ্ট্যই হলো কোন বিষয় যেমন খুব বড় কাঠামোতে থাকে ঠিক তেমনিভাবে অতি ক্ষুদ্র কাঠামোতে সূত্রাকারেও থাকে। যজ্ঞ কর্মের বিধানগুলো শতপথ ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মতো বৃহৎ বৃহৎ ব্রাহ্মণগুলোতে যেমন বিস্তারিতভাবে দেয়া আছে। ঠিক তেমনি এ বিধানগুলোই আছে বিভিন্ন শ্রৌতসূত্রগুলোতে সূত্রাকারে সংক্ষিপ্তভাবে। বেদান্তে যে জ্ঞানের কথা আছে তাই আছে বেদান্তসূত্রে। যা আমাদের কাছে ব্রহ্মসূত্র নামে প্রচলিত। এর অন্য নাম ব্যাসসূত্র, ভিক্ষুসূত্র, শারীরিকসূত্র, বাদরায়ণসূত্র ইত্যাদি। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে বেদ দুটি কাণ্ডে বিভক্ত- কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। সংহিতা এবং ব্রাহ্মণকে বলা হয় কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক এবং উপনিষদকে বলা জ্ঞানকাণ্ড। কিন্তু প্রচলিত এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বেদ অর্থই জ্ঞান। সর্বপ্রকার জ্ঞান যা জীবকে নিঃশ্রেয়স এবং অভ্যুদয় দুই দান করে। অভ্যুদয়ের মাধ্যমে আমরা জাগতিক সমৃদ্ধি লাভ করি এবং নিশ্রেয়সের মাধ্যমে আমরা মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ ও কৈবল্য লাভ করি। যদিও বেদ মানে জ্ঞান এবং বেদবিদ্যার সর্বস্থানেই জ্ঞানতত্ত্ব আছে। এরপরও আমরা বেদের জ্ঞানকাণ্ডের শেষ অংশকে অর্থাৎ উপনিষদকে সাধারণত বেদান্ত বলে থাকি। উপনিষদগুলো বেদের কোন না কোন অংশের সাথে যুক্ত। কোনটি সংহিতার সাথে, কোনটি ব্রাহ্মণের সাথে, কোনটি আরণ্যকের অথবা কোনটি পরম্পরাগতভাবে যুক্ত।
আরণ্যকে যে অধ্যাত্মবিদ্যার সূচনা উপনিষদে তা চরম শিখরে পৌঁছে জ্ঞানরাজ্যের মুকুটমণিতে পরিণত হয়েছে। উপনিষদ শব্দের ব্যুৎপত্তি হলো উপ-নি+সদ্+ক্বিপ্=উপনিষধদ। ‘উপ’ অর্থ নিকটে। ‘নি’ অর্থ নিশ্চিতভাবে। ‘সদ্’ অর্থ বিনাশ করা। অর্থাৎ ব্যুৎপত্তিগতভাবে উপনিষদ শব্দের অর্থ হল আচার্যের নিকট উপস্থিত হয়ে নিশ্চয়ের সাথে বেদবিদ্যা অনুশীলনের মাধ্যমে অজ্ঞান-অবিদ্যার যা বিনাশ করে তাই উপনিষদ। উপনিষদ ১৪টি।
ঋগ্বেদের ঐতরেয় উপনিষদ এবং কৌষীতকি বা শাংখ্যায়ন উপনিষদ।
সামবেদের ছান্দোগ্য উপনিষদ এবং কেন ‘উপনিষদ।
কৃষ্ণযজুর্বেদের-কঠ উপনিষদ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, মৈত্রায়নী উপনিষদ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ এবং মহানারায়ণ উপনিষদ।
শুক্লযজুর্বেদের- ঈশ উপনিষদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ।
পরিশেষে অথর্ববেদের প্রশ্ন উপনিষদ, মণ্ডুক উপনিষদ এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদ।
এ উপনিষদগুলো ব্যতীত অন্য যেসব উপনিষদ আছে তা শুধু নামেই উপনিষদ। এর সাথে বেদের কোন রূপ সম্পর্ক নেই।
‘বেদান্ত’ বললে যেমন শুধু উপনিষদকে বোঝায়, তেমনিভাবে ‘বেদান্তদর্শন’ বললে বোঝায় প্রস্থানত্রয়ীকে। ‘প্রস্থান’ বলতে চলে যাওয়া বোঝায়। কোথায় চলে যাওয়া? তত্ত্বেও চলে যাওয়া, ব্রহ্মের কাছে চলে যাওয়া। এ প্রস্থান অর্থাৎ ব্রহ্মের কাছে চলে যাবার পথ তিন প্রকার।
এ কারণে তাকে প্রস্থানত্রয়ী বলা হয়। এ প্রস্থানত্রয়ী হলো-
(১) শ্রুতি প্রস্থান : বেদ শ্রুতি পরম্পরায় রক্ষিত ছিল বহুদিন। তাই তাঁর এক নাম শ্রুতি। শ্রুতি প্রস্থান বলতে উপনিষদকে বোঝায় অর্থাৎ উপনিষদের অধ্যাত্মতত্ত্বের মাধ্যমে অমৃতময় ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থান করা।
(২) স্মৃতি প্রস্থান : বেদের জ্ঞানকাণ্ড উপনিষদের সারাংশ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে বলা হয় স্মৃতিপ্রস্থান।
(৩) ন্যায় প্রস্থান : ঋষি বাদরায়ণ রচিত ব্রহ্মসূত্র। যা চারটি অধ্যায়ে এবং ৫৫৫টি সূত্রে অখিল বেদবিদ্যাকে প্রকাশ করেছে। প্রথম অধ্যায়ে বেদবাক্যসমূহের সমন্বয়, দ্বিতীয় অধ্যায়ে অবিরোধ, তৃতীয় অধ্যায়ে সাধন এবং চতুর্থ অধ্যায়ে সিদ্ধি বা ফল বর্ণনা করে অনন্ত অধ্যাত্ম শাস্ত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ সংক্ষিপ্ত সূত্রশাস্ত্রের মাধ্যমে ব্রহ্মতত্ত্বে প্রস্থিত হবার অনন্য পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে। বেদান্তদর্শন বা প্রস্থানত্রয়ীর দিকে তাকালে আমরা দেখি বেদের লক্ষ লক্ষ মন্ত্রকে সারাংশ করে নিয়ে আসা হয়েছে বেদের জ্ঞানকা- উপনিষদে। লক্ষ লক্ষ মন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রায় দু’সহস্র মন্ত্রে; অর্থাৎ চতুর্দশ উপনিষদে। উপনিষদের প্রায় দু’সহস্র মন্ত্রকে নিয়ে আসা হয়েছে সহজ, সরল, সর্বজনগ্রাহ্য করে মাত্র ৭০০ শ্লোকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়। এ কারণে গীতাকে সর্ব উপনিষদের সার বলা হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এ ৭০০ শ্লোককে পরবর্তী কালে আরও সংক্ষেপ করে নিয়ে আসা হয়েছে ব্রহ্মসূত্রে। মাত্র ৫৫৫টা সূত্রে। দু-তিনটি শব্দের এক একটি সূত্রে। এ ৫৫৫টা সূত্রে বলা বেদান্তদর্শনের তত্ত্বকে আবার বলে দেয়া হয়েছে প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাদের চারটি সূত্রে। এ সূত্রগুলোকে একসাথে বলা হয় ‘চতুঃসূত্রী’।
ভারতবর্ষে পূর্বে যতগুলি মত-পথ এবং দার্শনিক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে তার প্রত্যেকটি বেদান্তদর্শনের ভাষ্যের উপর ভিত্তি করে। প্রত্যেক আচার্য তাঁদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বেদান্তসূত্রের ভাষ্য রচনা করে। মানব সভ্যতায় বেদান্তের দান অপরিসীম। ভারতীয় দর্শনের এবং জাতীয় জীবনের মূলাধার বেদান্ত। বেদান্তের মূল তত্ত্বগুলি যেমন শঙ্কর, রামানুজ, নিম্বার্ক, বলদেবাদি সংস্কৃত ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত আচার্যবৃন্দকে পথ দেখিয়েছে; ঠিক তেমনি যুগপৎভাবে পথ দেখিয়েছেন, কবির, দাদু, রবিদাস, রামকৃষ্ণ, লালন ইত্যাদি মাটির খুব কাছাকাছি সন্তবৃন্দকে। বেদান্তের জ্ঞান কেউ পেয়েছে পুস্তকের মাধ্যমে, কেউ পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে। আবার কেউ হয়ত পেয়েছে অবরোহ পদ্ধতিতে। সাধু চরিত্রের মা
No comments:
Post a Comment